ভারতের উত্তর-পূর্বের রাজ্য মণিপুর আবারও সহিংসতার কবলে পড়েছে এবং পরিস্থিতি এখন নিয়ন্ত্রণের বাইরে। এই রাজ্যটি ভারতের "সেভেন সিস্টার্স" নামক পরিচিত অঞ্চলের অন্যতম, এবং বর্তমান পরিস্থিতি এমন যে, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী এন বিরেন সিংয়ের বাড়িতেও হামলা হয়েছে। মণিপুরের সংঘাতের জেরে রাজ্যে শান্তি ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে কেন্দ্রীয় সরকারের পদক্ষেপ প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে।

মণিপুরে সংঘাত শুরু হওয়ার পর থেকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী একবারও রাজ্যটিতে সফর করেননি। সূত্রমতে, তিনি রাজ্যটিতে যেতে ভয় পাচ্ছেন, যেখানে সেনা পাহারা, কারফিউ এবং ইন্টারনেট বন্ধের মতো পদক্ষেপও কার্যকর হচ্ছে না। এমনকি, মণিপুরের পরিস্থিতি আরও ঘোরালো হয়েছে, যখন গত শনিবার রাজ্যটির মুখ্যমন্ত্রী, সহ বিধায়ক এবং সরকারি কর্মকর্তাদের বাড়িতে হামলা হয়েছে। এই ঘটনার পর প্রশ্ন উঠেছে, আসলে মণিপুরের নিয়ন্ত্রণ কী ভারতের হাতে আছে?

এই অবস্থার মধ্যে বিরোধী দলগুলো বিশেষ করে কংগ্রেস, প্রধানমন্ত্রী মোদীকে মণিপুর সফরে যাওয়ার জন্য চাপ দিচ্ছে। তাদের দাবি, প্রধানমন্ত্রী যদি রাজ্যটি শান্ত করার জন্য পদক্ষেপ না নেন, তাহলে দেশবাসী আরও বড় সংকটের মুখে পড়বে। তবে মোদী সরকার এখনও রাজ্যের পরিস্থিতি নিয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়েছে, এমনটাই অভিযোগ বিরোধী দলের।

মণিপুরের পরিস্থিতি দিন দিন আরও খারাপ হচ্ছে। গত ১১ দিন আগে কুকি জনগণের ১১ সদস্যকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী হত্যা করেছে, যদিও তাদের দাবি তারা জঙ্গি নয়, বরং স্বেচ্ছাসেবক ছিলেন। এছাড়া, নদী থেকে ৬ জনের মরদেহ উদ্ধার হওয়া এবং সেই ঘটনার পরপরই মণিপুরে নতুন সংঘাত শুরু হয়েছে। সরকারি বাহিনী এবং কুকি জনগণ একে অপরকে এই হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী করছে, যা পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত করেছে।

শনিবার, কারফিউ এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সত্ত্বেও উত্তেজিত জনতা মুখ্যমন্ত্রী এন বিরেন সিংয়ের বাড়িতে হামলা চালায়। নিরাপত্তারক্ষীরা কাঁদানে গ্যাস ছুঁড়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে, তবে ওই সময় মুখ্যমন্ত্রী বাড়িতে ছিলেন না এবং তিনি রাতটা তার দপ্তরে কাটিয়েছেন বলে জানা গেছে। এছাড়া, মণিপুরের স্বাস্থ্যমন্ত্রী এবং অন্যান্য সরকারি কর্মকর্তার বাড়িতেও হামলা হয়েছে। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী কুকিরা ২৪ ঘণ্টার আলটিমেটাম দিয়ে রাজ্য সরকারকে হুঁশিয়ারি দিয়েছে—কুকিদের দমন না করতে পারলে রাজ্যজুড়ে অকল্পনীয় সহিংসতা শুরু হবে।

কুকি জনগণ এবং সরকারি বাহিনী একে অপরকে দায়ী করে সংঘর্ষ চালিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ যে ইন্টারনেট বন্ধ, কারফিউ এবং সেনা উপস্থিতি এসব পদক্ষেপও জনতা মেনে নিচ্ছে না। এই পরিস্থিতি ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার এবং রাজ্য সরকার দু’টির জন্যই বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এমন সময়, বিরোধী দলগুলো মণিপুরের পরিস্থিতি নিয়ে মোদী সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করছে। কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী সহ অন্যান্য বিরোধী নেতারা প্রধানমন্ত্রীর কাছে মণিপুর সফরের দাবি জানিয়েছেন। তারা প্রশ্ন তুলেছেন, যখন প্রধানমন্ত্রী দেশের বিভিন্ন জায়গায় সফরে যান, তখন কেন মণিপুর সফর করতে ভয় পাচ্ছেন?

মণিপুরের এই ভয়াবহ পরিস্থিতি দেশে আরো বড় রাজনৈতিক প্রশ্ন তুলছে। কিছুদিন আগে গণমাধ্যমে খবর বেরিয়েছিল যে, মণিপুরের জঙ্গলে অস্ত্রের বিশাল ভাণ্ডার জমা হয়েছে, যা সেভেন সিস্টার্স রাজ্যটি ভারত থেকে আলাদা করতে ব্যবহার হতে পারে। মণিপুরের বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীগুলি, বিশেষ করে কুকিরা, মিয়ানমারের চিন রাজ্য এবং মিজোরামের সঙ্গে মিলে নিজেদের জন্য একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের দাবি করছে। এই পরিস্থিতি যদি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়, তাহলে সেটি ভারতের জন্য একটি বড় নিরাপত্তা সংকট হয়ে উঠতে পারে।

এখনো পর্যন্ত রাজ্যটি শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি, এবং মণিপুরের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনেক প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। মোদী সরকারের জন্য এটি একটি বড় চ্যালেঞ্জ, যেখানে রাজ্যের নিয়ন্ত্রণ ও শান্তি প্রতিষ্ঠা করা একটি কঠিন কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে।